রিয়াদ – নীরব বাস্তবতার এক যোদ্ধারিয়াদ বাইরে থেকে কঠিন, ঠান্ডা ও হিসেবি একজন মানুষ। তার চারপাশে মানুষ আছে, তবু সে ভীষণ একা। কথাবার্তায় যুক্তিবাদী, পরিকল্পনায় বাস্তববাদী। প্রেম-ভালোবাসা—এসবকে সে দুর্বলতার প্রতীক বলে মনে করত।ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার সীমিত সামর্থ্যের মাঝে বড় হয়েছে। সে জানে জীবন মানেই সংগ্রাম, আর স্বপ্ন মানে ত্যাগ। তার চোখে একটাই লক্ষ্য—নিজের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবে, যেখানে প্রযুক্তি দিয়ে সমাজে কিছু পরিবর্তন আনবে। পাশাপাশি পরিবারকে এমন জীবন দেবে, যা তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।কিন্তু রিয়াদের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর একাকীত্ব। সে কখনো তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। ভালোবাসা তার কাছে অজানা এক ভাষা। সে জানে না, কারো চোখে চোখ রেখে বলা যায়—"আমি ভালো আছি না।"আর এই অক্ষমতাই তার বড় দুর্বলতা।সুমাইয়া – রঙে ভরা নিঃশব্দ আর্তিসুমাইয়া এক গভীর অনুভূতির নাম। সে শব্দে নয়, রঙে কথা বলে। তার তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠে ভালোবাসা, ব্যথা, অভিমান, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি। ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর থেকে তার মনটা যেন একটানা কাঁদে, কিন্তু সে তা কাউকে বোঝায় না—শুধু ছবি আঁকে।তার বাবা একজন স্কুলশিক্ষক। সীমিত আয়ে অনেক স্বপ্ন বয়ে বেড়ান। সুমাইয়া ঠিক করেছে, সে তার আঁকার মাধ্যমেই একদিন নিজেকে প্রমাণ করবে—একজন সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে। সেইদিন তার বাবা তাকে দেখে বলবেন, "আমার মেয়ে আমার গর্ব।"তবে তার হৃদয়টা খুব নরম। সে কারো একটু ভালোবাসায় ভেসে যেতে পারে। সহজেই গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে কারো সঙ্গে। কিন্তু সেই ভালোবাসা যদি প্রত্যাখ্যান হয়—সে ভেঙে পড়ে।তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়—কেউ যদি তার অনুভূতির দাম না দেয়।রিয়াদ গ্যালারিতে ফিরে এসে বারবার সুমাইয়ার ছবিটার কথা ভাবছে। সে ইনস্টাগ্রামে “@artbysumaiya” নামে একটা প্রোফাইল খুঁজে পায়। ডিপি-তে সেই মেয়েটির মুখ, যার সাথে চোখে চোখ রেখে মনে হয়েছিল—কারো চোখে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।রিয়াদ মেসেজ করে:"আপনার ছবির নিচে দাঁড়িয়ে আমার পৃথিবীটা এক মুহূর্ত থেমে গিয়েছিল। একটা কফি হবে?"সুমাইয়া রিপ্লাই করে:"শুধু কফির জন্য, না নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য?"তাদের কথোপকথনের শুরুটা হয় দারুণ হৃদ্যতায়। যেন দুই ভিন্ন জগতের মানুষ এক আশ্রয়ে এসে দাঁড়াল।এক বিকেলে, পার্কের এক শান্ত কোণায় সুমাইয়া রংতুলি হাতে চুপচাপ বসে আঁকছে। রিয়াদ এসে তার পাশে বসে।সে বলল, "তুমি জানো, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো খুব আবেগপ্রবণ। কিন্তু তুমি আসলে অসম্ভব শক্ত একজন মানুষ।"সুমাইয়া হেসে উত্তর দেয়, "আবেগ শক্তি হতে পারে, যদি কেউ সেটা বোঝে।"রিয়াদ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।"তুমি কেমন করে এত সহজে বুঝে যাও আমার চুপ থাকা?"সুমাইয়া শান্ত গলায় বলে, "কারণ তুমিও আমার মতো—বলে না, শুধু অনুভব করো।"তাদের চোখে এক গভীর বোঝাপড়া। না বলা কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়।একদিন, রিয়াদ সুমাইয়াকে তার নতুন স্টার্টআপ অফিসে নিয়ে যায়। অগোছালো ডেস্ক, কিছু টানাপোড়েন, আর অনেকগুলো স্বপ্ন। সুমাইয়া চুপচাপ সব কিছু দেখে। তারপর ডেস্কের পাশে দেয়ালে একটা স্কেচ টাঙিয়ে দেয়—রিয়াদের একটা রাফ পোর্ট্রেট, চোখে স্বপ্ন।সে বলে, “তুমি স্বপ্ন দেখো, আমি তার রঙ দিই।”রিয়াদ প্রথমবার সত্যিই অনুভব করে—এই মানুষটা শুধু পাশে নেই, সে ভিতরে ভিতরে তাকে গঠন করছে।প্রেম তখনও প্রকাশ হয়নি, কিন্তু দুজনেই জানে—এটা আর শুধু বন্ধুত্ব নয়।রাত ২টা। বাইরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ফোন বাজে। সুমাইয়া ফোন করে নিঃশব্দে বলে,"আমার মা চলে যাওয়ার পর এইরকম ঝড়ে আমি খুব একা হয়ে যেতাম..."রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বলে,"আজ থেকে এই ঝড়ে তুমি একা থাকবে না। আমি থাকব।"সুমাইয়া জিজ্ঞেস করে,"তুমি কি সবসময় থাকবে?"রিয়াদ একটু থেমে বলে,"আমি তো অনেক আগে থেকেই আছি। তুমি শুধু বোঝোনি…"একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। তারপর নিঃশব্দ ভালোবাসা দুই ফোনের মাঝখানে জমে থাকে।তারা কখনও "আমি তোমাকে ভালোবাসি" বলেনি।কিন্তু রিয়াদ যখন অসুস্থ হলে সুমাইয়া রাত জেগে ফোনে পাশে থাকে, কিংবা সুমাইয়ার এক্সিবিশনে রিয়াদ চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে—তখন প্রেম নিজের ভাষা খুঁজে নেয়।একদিন, হঠাৎ সুমাইয়া বলে,"তুমি জানো? আমি তোমাকে দেখে একটা ছবি আঁকছি, নাম দিয়েছি ‘আমার নীরব ঠিকানা’।"রিয়াদ হালকা হেসে বলে,"তাহলে আমার নাম এবার তোমার ক্যানভাসে উঠলো?"সুমাইয়া তার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,"তুমি তো আমার জীবনেই উঠে গেছো।"রিয়াদ ধীরে সুমাইয়ার দিকে তাকায়। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দেয়।না কোনো নাটকীয়তা, না অতিরিক্ত আবেগ—শুধু এক গভীর চেনা নির্ভরতা।তারা দুজনেই জানে—এই সম্পর্কটা এখন আর বন্ধুত্ব নেই, এটা ভালোবাসা। গভীর, নিঃশব্দ, স্থায়ী।( চলমান )_১